
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ এত ধীর গতিতে কেন এগোচ্ছে?
দখলকৃত ইউক্রেনীয় দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর পোলোহির কাছে একটি পাহাড়ের চূড়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী একটি পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি স্থাপন করেছে। যেখান থেকে ৬ মাইলেরও বেশি দূরে ইউক্রেনীয় সেনাদের দেখতে পায় তারা। ইউক্রেনের ১০৮তম টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওলেকসি টেলিহিন বলছেন, চারবার ইউক্রেনীয় বাহিনী মুরোম-এম নজরদারি ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। কিন্তু চারবারই অবিলম্বে নতুন ব্যবস্থা স্থাপন করেছে রুশরা।
গত বছর সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র কম এবং বিমানবাহিনী দুর্বল হওয়ার পরও রাশিয়ার বিশাল বাহিনীকে সফলভাবে টেক্কা দিয়েছিল ইউক্রেন। চতুর কৌশল, অঞ্চল সম্পর্কে ভালো ধারণা এবং ড্রোন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার করে তাদের চেয়ে বড় সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু সেই দিন আর এখন নেই। ইউক্রেনকে এখন পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা একটি সেনাবাহিনীকে উৎখাতের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। যা বিশ্বের যেকোনও সেনাবাহিনীর জন্য কঠিন অভিযান। কয়েক মাস ধরে রাশিয়া ১৫ মাইল গভীর পর্যন্ত বাংকার, ট্যাংকের জন্য ফাঁদ ও মাইন পুঁতে কঠোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
যুদ্ধের এই পর্যায়ে পরিখায় অবস্থান নেওয়া রুশ সেনাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর মন্তব্য সরঞ্জামের অভাববোধ করছে ইউক্রেন। গত কয়েক মাসে পশ্চিমাদের কাছ থেকে নতুন অস্ত্র পাওয়ার পর এবং শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র প্রাণঘাতী ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজভ সাগরের দিকে ইউক্রেনের এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা মূলত থমকে আছে। যদিও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তারা অগ্রগতি অর্জন করছে এবং জাপোরিজ্জিয়া ও ডনেস্ক অঞ্চলে গত কয়েক মাসে কয়েকটি গ্রাম পুনরুদ্ধার করেছে। একই সঙ্গে তারা তাদের সামরিক অভিযানের কঠিন প্রকৃতিও স্বীকার করে নিচ্ছেন।
লে. কর্নের টেলেহিন বলেন, আমরা যদি ১০০ সেনার একটি পুরো ইউনিট ধ্বংস করি। পরদিন তারা আরেকটি ইউনিট মোতায়েন করে। এভাবে দিনের পর দিন তারা নতুন ইউনিট মোতায়েন করে যাচ্ছে।
ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইন্সটিউশনের নিরাপত্তা গবেষণার বিশেষজ্ঞ মাইকেল ও’হ্যানলন বলছেন, আরও ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা করা রুশ সেনাদের জন্য গত বছরের অভিযান সফল ছিল না। কিন্তু প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান ধরে রাখা তাদের জন্য আক্রমণের চেয়ে সহজ হবে। গত বছর আড়াই লাখের বেশি নতুন সেনা নিয়োগ দিয়েছে মস্কো।
ইউক্রেনীয় সেনারা বলছেন, জাপোরিজ্জিয়া অঞ্চলে রুশরা কয়েক মাইল দীর্ঘ আন্তঃসংযুক্ত পরিখা খনন করেছে। এগুলোর কিছু অংশ অংশ কংক্রিট বা কাঠের ছাদ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ফলে ড্রোন ব্যবহার করেও এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। খোলা মাঠগুলোতে বিপুল পরিমাণ মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে নিহত ইউক্রেনীয় সেনাদের দেহও মাটিতে হারিয়ে গেছে।
ভাদোস নামের কল সাইন বা ছদ্ম নামধারী ইউক্রেনের ১০৮তম ব্রিগেডের রাইফেল ইউনিটের ৩৮ বছর বয়সী কমান্ডার বলছেন, এমন ভালো প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান নেওয়া বাহিনীকে পুরোপুরি ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। রুশ সেনাদের ধ্বংস করার জন্য ইউক্রেনের কামান বাহিনীর প্রথমে পুরো এলাকায় বোমাবর্ষণ করতে হয়। এরপর পদাতিক সেনাদের নিয়ে যেতে সাঁজোয়া যান ব্যবহার করতে হয়। ট্যাংক ও অপর সাঁজোয়া যানের ঘাটতির কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।
পরিখায় অবস্থান নেওয়া দখলদার সেনাদের ওপর আক্রমণ চালানো বিশ্বের যেকোনও শীর্ষ সেনাবাহিনীর জন্যও কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তি ফ্রান্সে ডি-ডেতে সাফল্য পাওয়ার পরও জার্মান অবস্থান গুঁড়িয়ে দিতে দুই মাস সময় নিয়েছে। ১৯৯১ সালে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের সময় ইরাকি অবস্থান গুঁড়িয়ে দিতে মার্কিন বাহিনীর পাঁচ সপ্তাহ সময় লেগেছে।
ইউক্রেনের সেনা সংখ্যার ঘাটতি ও বিমান বাহিনীর দুর্বলতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৯১ সালের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। পদাতিক বাহিনীকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছে বিমানবাহিনী। কিয়েভের বিমানবাহিনীর রয়েছে সোভিয়েত আমলের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার। এগুলোর কয়েকটি সম্প্রতি ন্যাটো মিত্ররা সরবরাহ করেছে। বিপরীতে রাশিয়া অত্যাধুনিক সুখই যুদ্ধবিমান ও কেএ-৫২ হেলিকপ্টার মোতায়েন করছে দক্ষিণাঞ্চলীয় রণক্ষেত্রে।
ইউক্রেনের কট্টর মিত্র পোল্যান্ড সম্প্রতি কিয়েভকে প্রায় এক ডজন সোভিয়েত আমলের এমআই-২৪ হেলিকপ্টার গানশিপ সরবরাহ করেছে। এই সরবরাহের কথা আগে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়নি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছেন। এরপরও রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেনের বহর অনেক ছোট এবং নির্ভুলভাবে আঘাতের সক্ষমতাও কম। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কিয়েভ খুব সতর্কতার সঙ্গে এগুলো ব্যবহার করছে।
ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনীয়রা অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের রাশিয়ার প্রতিরক্ষা রেখায় তুমুল লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি আমাদের অব্যাহত সমর্থন দাবি করছে।
লিথুয়ানিয়াতে আসন্ন ন্যাটো সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি উপস্থিত হবেন। স্টোলটেনবার্গ বলছেন, এই শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটো নেতারা ইউক্রেনের জন্য যত দিন প্রয়োজন সহযোগিতা দিয়ে যাওয়ার বার্তা দেবেন।
যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের বিষয়টি ন্যাটো মিত্ররা আলোচনা করছে। তবে চলতি বছরে এসব যুদ্ধে নামতে পারবে বলে মনে হয় না। এফ-১৬ যুদ্ধবিমান না থাকায় ইউক্রেন সব ধরনের গোলাবারুদ চাইছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা সরবরাহ করবে। এসব অস্ত্র রাশিয়ার আরও বেশি সেনাকে হত্যা বা আহত করতে পারবে। কামান থেকে ছোড়া এসব বোমা বিস্তৃত এলাকায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বোমা ছড়িয়ে দেয়। এসব ছোট বোমার অনেকগুলোই অবিস্ফোরিত থেকে যায়। ফলে যুদ্ধ অবসানের পরও বেসামরিকদের হতাহতের ঝুঁকি থাকে।
পদাতিক বাহিনী পাঠানোর আগে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দুর্বল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিয়েভ। কিন্তু রুশ নিয়ন্ত্রিত গ্রামগুলোতে টানা গোলাবর্ষণের মতো গোলাবারুদ নেই তাদের কাছে। যেমনটি বাখমুতে করেছিল রাশিয়া। এর পরিবর্তে ইউক্রেনীয় সেনারা ড্রোন দিয়ে রুশদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর কামানের গোলাবর্ষণ করছে।
সেনারা বলছেন, সাঁজোয়া যানের ঘাটতি তাদের অগ্রগতির চেষ্টাকে মন্থর করে দিচ্ছে। জাপোজ্জিয়া অঞ্চলের রাইফেল ইউনিটের কমান্ডার ভাদোস বলেছেন, রাশিয়ার দখলে থাকা একটি গ্রামে তার ইউনিট আক্রমণের চেষ্টা করেছিল। ইউক্রেনীয় পদাতিক বাহিনী পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রুশরা তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে গ্রামটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা না করেই ফিরে আসতে হয়েছে তাদের।
ভাদোস বলেন, ‘আমাদের যদি আরও সাঁজোয়া যান থাকতো তাহলে আমরা আরও বেশি সেনাদের নিয়ে আসতে পারতাম।’
পাল্টা আক্রমণ শুরুর পর প্রায় এক মাসের মধ্যে ভালো প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা কোনও রুশ অবস্থান দখলের অভিযানে তিনি ছিলেন না বলে উল্লেখ করেছেন ভাদোস।
ইউক্রেন এখনও নতুন পশ্চিমা সরঞ্জামগুলোর বেশিরভাগ যুদ্ধে মোতায়েন করেনি। কিয়েভের কাছে কয়েক ডজন জার্মান তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক রয়েছে। তবে জুনের শুরুতে তাদের বেশ কয়েকটি মাইন ফিল্ডে আটকে যাওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলোকে দেখা যায়নি। এই বছরের শুরুর দিকে পশ্চিমা সরঞ্জামগুলোর প্রশিক্ষণ নেওয়া কয়েকটি ব্রিগেডকেও আক্রমণ শুরু হওয়ার পর লড়াইয়ে ব্যবহার করা হয়নি।
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউক্রেন বেশিরভাগ পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার শুরু করার আগে রুশদের দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। পুনরুদ্ধার অভিযান কঠিন কারণ রুশরা প্রায়শই ইউক্রেনীয়দের খোলা জায়গা দিয়ে আসতে দেখতে পাচ্ছে।
পলোহির কাছে পাহাড়ের চূড়া রাশিয়ার অবস্থান বিশেষভাবে হতাশাজনক। উঁচু অবস্থানে রুশ সেনাদের মোতায়েন থাকা তাদের জন্য জটিলতা তৈরি করছে, বিপরীতে এটি মস্কোর সেনাদের একটি বড় সুবিধা দিচ্ছে।
উঁচু ভূমি সর্বদাই যুদ্ধের সবচেয়ে মূল্যবান ভূখণ্ড এবং সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। প্রথম শতাব্দীর মাসাদা অবরোধ থেকে গেটিসবার্গের যুদ্ধ পর্যন্ত লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছিল উঁচু ভূমি।
যুদ্ধের পুরো সময়জুড়েই নিজেদের বাহিনীর হতাহতের কথা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা। তবে দক্ষিণাঞ্চলীয় রণক্ষেত্রের সেনারা বলছেন, অনেক সময় একটি ইউনিট এক হামলায় কয়েক ডজন সেনা হারাচ্ছে।
কল সাইন বল্ড নামের ১৯ বছর বয়সী যুদ্ধের চিকিৎসক বলেছেন, সম্প্রতি একটি হামলার পর আহতদের নিয়ে আসতে তিনি তিনবার ছুটে গিয়েছেন, আট জনকে ফিরিয়ে এনেছেন। গ্রীষ্মের শুরুতে আহতদের ফিরিয়ে আনার সময় তার গাড়িতে একটি মর্টার আঘাত করে। পরে আরেকটি গাড়ি হতাহতদের নিয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘উদ্ধারকারী দলকেই আমাদের উদ্ধার করতে হয়েছিল।’
গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার কয়েকটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে ইউক্রেনীয় সেনারা। জাপোরিজ্জিয়া ও ডনেস্ক অঞ্চলের সীমানায় ইউক্রেনের বিমানবিধ্বংসী ইউনিটের এক সেনা বলেছেন, অনেক সময় রাশিয়ার হেলিকপ্টার ইউক্রেনীয় সেনাদের মাত্র ৫ মাইল দূর দিয়ে উড়ে যায়। এতে রাশিয়ার হামলার নির্ভুলতার সুযোগ বাড়ে। কিন্তু এগুলোকে ভূপাতিত করার ঝুঁকিও বাড়ে। সোভিয়েত আমলের বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থা ব্যবহার করে গত মাসে এক সপ্তাহে দুটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করা হয়েছে।
এরপরও পদাতিক বাহিনীর সেনারা বলছেন, রুশ উড়োজাহাজ তাদের জন্য হুমকি।
১০৮তম ব্রিগেডের ৪০ বছর বয়সী প্লাটুন কমান্ডার দিমিত্রো বলেন, এই হুমকি মোকাবিলার জন্য আমাদের উপযুক্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। যখন শত্রুর বিমান উড্ডয়ন শুরু করার পর আমাদের সতর্ক করা হয় তখন আড়াল নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না আমাদের।
অঞ্চলটির বিস্তীর্ণ সমতল মাঠ ও হালকা গাছের সারিতে সেনাদের সামান্য সুরক্ষা দেয়। বসন্তে এই এলাকায় লড়াই করা অনেক সেনা ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পাল্টা আক্রমণ সফল হবে কি না প্রশ্ন তুলেছিলেন।
লে. কর্নেল টেলেহিন বলেছেন, আক্রমণের জটিলতা অবাক করার মতো কিছু না। তার মতে, ‘আমরা জানতাম এই ধরনের ভালো প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া রুশদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে আমাদের অভিজ্ঞতা, সরঞ্জাম এবং চমকে দেওয়ার মতো সক্ষমতা প্রয়োজন।’
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অবলম্বনে।