আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধ এরদোয়ানের জন্য পোয়াবারো

ইউক্রেনের সঙ্গে তুরস্কের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গভীর করছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। একই সঙ্গে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও যোগাযোগের সুযোগ উন্মুক্ত রেখেছেন। এই সম্পর্কের ফলেই গত সপ্তাহে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদশস্য রফতানি অব্যাহত রয়েছে। এমন সময় এসব ভূমিকা রাখছেন এরদোয়ান যখন তিনি আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্কের ভূমিকা বিস্তৃত করতে চাইছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে তুরস্কের বিখ্যাত অস্ত্র নির্মাতা বায়কার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে একটি নতুন কারখানা স্থাপনের চুক্তি করেছে। এতে করে কোম্পানিটির সশস্ত্র ড্রোন উৎপাদনের সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে। গত মাসে ইউক্রেনের নৌবাহিনীকে একটি নতুন জাহাজ সরবরাহ করেছে তুরস্ক। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ ও ফার্স্টলেডি ওলেনা জেলেনস্কি। মিলজেম ক্লাসের এই জাহাজটি ইউক্রেনীয় নৌবহরের মধ্যে বৃহত্তম। যা কৃষ্ণ সাগরে রুশ আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এবং তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব তুলে ধরছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যে বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরেছিলেন তা সরবরাহ করেছে তুরস্ক। এছাড়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ও সামরিক যান সরবরাহ করেছে আঙ্কার। যখন পুতিন কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনীয় খাদ্যশস্য রফতানির চুক্তিতে অংশগ্রহণ বাতিল করে পুনরায় অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন তখন এরদোয়ান নৌযান চলাচল অব্যাহত এবং বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে মধ্যস্থতা করেন।

মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এরদোয়ান গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তার এই লক্ষ্য অর্জনকে সহজ করেছে। আর তা হলো: পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে মোটা দাগে বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তুরস্কে রুশ অর্থের প্রবাহ জারি রাখতে তার সম্মতি।

নিজের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা কখনও গোপন করেননি এরদোয়ান। ছবি: এপি

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বিশ্বের অল্প যে কয়জন নেতা নিয়মিত কথা বলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট তাদের একজন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা জারির পরও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যা রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ দিচ্ছে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা শাখার সাবেক প্রধান আলপার জসকুন বলেন, দৃশ্যত তা ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতে ভারসাম্যমূলক অবস্থান নেওয়ার নিরিখে তুরস্কের নিজের স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি ত্রুটিমুক্ত।

ইউক্রেন যুদ্ধে সফলতায় বিভিন্ন দেশ তুর্কি ড্রোন কিনতে আগ্রহী। ছবি: রয়টার্স

তুরস্কের অস্ত্র সরবরাহ যতদিন অব্যাহত রয়েছে ততদিন ইউক্রেনও এই বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করবে না বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে। ইউক্রেনের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেজর জেনারেল ভলোদিমির হাভ্রিলোভ বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্কের অবস্থান আমরা বুঝতে পারি।

ইউক্রেন যুদ্ধ তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা শিল্পকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগের সামনে হাজির করেছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সিরিয়া, লিবিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে ছায়াযুদ্ধ ঘিরে পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য আরও বিস্তৃত করেছে। নিজের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা কখনও গোপন করেননি এরদোয়ান। বিশ্বজুড়ে ২৪টির মতো দেশে তুরস্কের নির্মিত ড্রোন বিক্রি করছেন, তুর্কিক রাষ্ট্রগুলোর একটি পরিষদের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় কূটনৈতিক প্রভাব গড়ে তুলছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক জোরদার করে সম্পর্ক গভীর করছেন।

রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছিলেন এরদোয়ান। ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে পাঠানো তুরস্কের নতুন সামরিক চালানের মূল পণ্য হলো কয়েক ডজন বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন। রুশ আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেনের প্রাথমিক প্রতিরোধে এই ড্রোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই ড্রোন ব্যবহার করে রুশ সামরিক বহর গুড়িয়ে দিয়েছে ইউক্রেন, ডুবিয়েছে রুশ যুদ্ধজাহাজ। এই ড্রোনগুলো রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এতটা কার্যকরভাবে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে যে ইউক্রেনীয়রা গান লিখেছে এবং টি-শার্টে ছবি ছেপেছে। এগুলোকে তারা দেশটির প্রতিরোধের একটি প্রতীক হিসেবে হাজির করছেন।

তুর্কি বায়কার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, ইউক্রেনে তাদের ৩০ হাজার বর্গ মিটারের কারখানা গড়ে তুলতে ব্যয় হচ্ছে ১০ কোটি ডলার। তিন বছরের মধ্যে পুরোদমে কারখানায় ড্রোন উৎপাদিত হবে। কোম্পানিটির বর্তমান ড্রোনের উৎপাদন তখন দ্বিগুণ হবে। এখন বছরে ২০০টি ড্রোন উৎপাদন করে বায়কার।

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তুর্কি কোম্পানি বায়কার-এর প্রধান। ইউক্রেন ড্রোন কারখানা স্থাপন করবে কোম্পানিটি। ছবি: রয়টার্স

কিয়েভে তুর্কি ড্রোন উৎপাদন কারখানা গড়ে তোলার খবরে খুশি হননি রুশ কর্মকর্তারা। নতুন কারখানায় হামলার হুমকিও দিয়েছেন তারা। বায়কারের সিইও হালুক বায়রাকতার হামলার হুমকি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই প্রকল্প ইউক্রেন ও তুরস্কের মধ্যে। এটি অন্য কারও বিষয় নয়।

বায়রাকতারের ভাই কোম্পানিটির প্রধান প্রযুক্তি প্রধান সেলজুক বায়রাকতার। তিনি এরদোয়ানের এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ ও অপর সংঘাতগুলোতে তুর্কি ড্রোনের সাফল্যে তুরস্কে দুই ভাই সেলিব্রেটি মর্যাদা পাচ্ছেন। এই সাফল্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন অর্ডারের পথ সুগম করে দিয়েছে। এমনকি ন্যাটো জোটের সদস্য রোমানিয়া ও পোল্যান্ডও এই ড্রোন কিনতে আগ্রহী। গত মাসে ইস্তাম্বুলে একটি প্রতিরক্ষা-শিল্প প্রদর্শনীতে হালুক বায়রাকতারের অটোগ্রাফ নিতে একদল ভক্ত জড়ো হয়েছিলেন। সহযোগীরা ভক্তদের সরিয়ে দেওয়ার আগে তাদের কয়েকজনকে তিনি অটোগ্রাফ দিয়েছেন।

ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জোরেশোরে প্রকাশ করছেন বায়রাকতার। তিনি অঙ্গীকার করেছেন কখন্ রাশিয়ার কাছে এই ড্রোন বিক্রি করবেন না। যা দৃশ্যত তুর্কি সরকারের নীতি থেকে আলাদা। তুর্কি সরকারের নীতি হলো রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বারোপ করা। এই বছরের শুরুতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান বলেছিলেন, ইউক্রেনের কাছে নতুন অস্ত্র বিক্রিতে তুরস্ক সতর্ক। শান্তির জন্য মধ্যস্থতা করার প্রবণতার অংশ হিসেবে তাদের এই সতর্কতা।  

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ভারসাম্য রাখার ক্ষেত্রে তুরস্কের চেষ্টার বিষয়ে বায়রাকতার বলেন, আমি সরকারের প্রতিনিধি নই। আমি বায়কার-এর ব্যবস্থাপক।

রাশিয়া ও পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের সামরিক সম্পর্ক নিয়ে অতি সতর্ক ইউক্রেন। ছবি: রয়টার্স

অবশ্য ইউক্রেন সরকার মাঝে মধ্যে তুরস্কের নিজেকে ক্ষমতার দালাল হিসেবে হাজির করার চেষ্টায় বিরক্ত হয়েছে। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন, এই বছরের শুরুতে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার চুরি করা শস্য কিনছে তুরস্ক। আঙ্কার বলেছে, তারা এই অভিযোগ তদন্ত করছে। গত মাসে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তুর্কি প্রতিষ্ঠান ২ রাখ বর্ডি আর্মর পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। এই বিষয়ে তুর্কি কর্মকর্তারা মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।

রাশিয়া ও পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের অতীত সামরিক সম্পর্ক নিয়েও অতি সতর্ক। ২০১৭ সালে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়টি অনুমোদন করেছেন এরদোয়ান নিজে। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব বেড়েছিল। তুরস্কের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাও জারি করে।

চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে এই সমালোচনাকারীদের মুখ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন এরদোয়ান। নির্দিষ্টভাবে বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন ইউক্রেন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ইউক্রেনীয় জেনারেল হাভ্রিলভ বলেন, রাশিয়া অত্যাধুনিক ও পরিশীলিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইউক্রেনে মোতায়েন করেছে। বায়রাকতার ড্রোনের জন্য এগুলো অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। তাই আমাদের কৌশল পাল্টাতে এবং সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে হয়েছে।

সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল

Source link

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Stream TV Pro News - Stream TV Pro World - Stream TV Pro Sports - Stream TV Pro Entertainment - Stream TV Pro Games - Stream TV Pro Real Free Instagram Followers PayPal Gift Card Generator Free Paypal Gift Cards Generator Free Discord Nitro Codes Free Fire Diamond Free Fire Diamonds Generator Clash of Clans Generator Roblox free Robux Free Robux PUBG Mobile Generator Free Robux 8 Ball Pool Brawl Stars Generator Apple Gift Card Best Android Apps, Games, Accessories, and Tips Free V Bucks Generator 2022