
ইমরানকে গ্রেফতারে নতুন সংকট, কোন পথে পাকিস্তান
পাকিস্তানের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজিরা দিতে যাওয়ার পর আদালত প্রাঙ্গন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানকে। গ্রেফতারের পর পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করলেও রাজধানীতে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। পিটিআই নেতারা অভিযোগ করেছেন, গ্রেফতারের সময় তাদের চেয়ারম্যানকে নির্যাতন করা হয়েছে। জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে সংকটের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ঋণ না পেলে পাকিস্তান ঋণখেলাপি হয়ে পড়বে বলে সতর্ক বার্তার মধ্যেই নতুন করে এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তীব্রতা পেলো। সম্প্রতি ইমরান খান ওয়াজিরাবাদে তাকে হত্যার চেষ্টায় সেনা কর্মকর্তা ডিজি-সি মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসের জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন। তার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
এর আগে কয়েক দফা তাকে গ্রেফতারে ব্যর্থ অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। বিশেষ করে লাহোরে তার জামান পার্ক বাসভবনে দুই দফা অভিযানে গেলেও তাকে গ্রেফতার না করেই ফিরতে হয় পুলিশকে।
যত সংকট
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান কখনোই একটি স্থিতিশীল দেশ ছিল না। দেশটির অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, রাজনৈতিকভাবে মেরুকরণ করা হয়েছে সমাজকে। লাখ লাখ মানুষ এখনও গত বছরের বিধ্বংসী বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় ব্যস্ত। এসবের পাশাপাশি দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলা ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছেই। অনেকে নিজেদের এবং তাদের সন্তানদের খাবার নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করছেন।
দেশের যখন এমন করুন দশা তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় কে থাকবেন তা নিয়ে রাজনীতিবিদ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চলছে টানাপড়েন।
সম্প্রতি স্বতন্ত্র মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তান (এইচআরসিপি) গণতান্ত্রিক রীতিকে অবমাননা করার জন্য বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করেছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক হারিস খালিক বরেছেন, শুধু রাজনীতি নয়, পুরো সমাজও গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বসে এবং জাতীয় স্বার্থের খাতিরে সংলাপের মাধ্যমে নিজেদের বিরোধ মীমাংসা না করলে আমরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নোংরা লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
সংকটের কারণ
প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের সিনিয়র নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, এই সংকটের জন্ম দিয়েছে ‘রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র’। এর মাধ্যমে তিনি মূলত দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনীকে ইঙ্গিত করেছেন।
তার কথায়, “পাকিস্তান নজিরবিহীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের মুখে। ইমরান খানকে উৎখাত ছিল ভুল এবং আমরা দেখছি জনগণ ও ‘ক্ষমতাসীন জান্তা’র মধ্যে এক বিভাজন তৈরি হয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেহমাল সরফরাজ বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পুরো ব্যবস্থাকে আরও কঠিন করে তুলছে। পাকিস্তানে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এতে রাজনৈতিক দল বা পাকিস্তানের জনগণ কেউ লাভবান হবে না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমরান খানকে ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করার পর থেকেই বর্তমান পরিস্থিতির জন্ম হয়।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘ইমরান খান বিষয়টাকে মেনে নেননি। আবার এটাও সত্যি যে ইমরান খানের সক্রিয়তা এবং আন্দোলনকেও উপেক্ষা করবে না সরকার।’
ইমরান খান পাকিস্তানজুড়ে একের পর এক সমাবেশ ও কর্মসূচির মাধ্যমে শাহবাজ সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছেন। প্রতিক্রিয়ায় ইমরানের বিরুদ্ধে আদালতের মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পিটিআই জানায়, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং আদালত অবমাননাসহ শতাধিক মামলা ঝুলছে ইমরানের কাঁধে। তিনি অবশ্য এসবকে স্বাভাবিক রাজনীতি হিসেবেই দেখছেন। তিনিও সরকারকে আদালতে টেনেছেন। জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে তার দল পিটিআই দেশের দুটি প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেয়। এটির মামলা এখনও সুপ্রিম কোর্টে চলছে।
এই চলমান আদালতের লড়াই বিচার বিভাগকে বিভক্ত করেছে। কয়েকজন বিচারকের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে। বিচার বিভাগে এই বিভাজন এবং তীব্র মতবিরোধ সাংবিধানিক সংকটের শঙ্কা তৈরি করছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিভাজন
মঙ্গলবার ইমরানকে গ্রেফতারের পর ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমের ফারুক ইসলামাবাদে পুলিশ প্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি ‘সংযম’ দেখাচ্ছেন এবং সতর্ক করে বলেছেন ১৫ মিনিটের মধ্যে ইসলামাবাদের পুলিশ প্রধান আদালতে হাজির না হলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘তলব’ করা হবে।
আমের ফারুক বলেন, দ্রুত আদালতে আসুন এবং আমাদের জানান কোন মামলায় ইমরানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এতে বিচার ব্যবস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিভাজন আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ আরও বাড়বে। বিচার ব্যবস্থা, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সংকট আরও জোরালো হবে অর্থনৈতিক নিম্নমুখীতার কারণে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো মাদিহা আফজাল সতর্ক করে বলছেন, আমি দেখছি এই সংকট গভীর হচ্ছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুব কঠিন হবে। সেনাবাহিনী, আইনসভা ও বেসামরিক সরকার ও বিচারব্যবস্থা-সবাই কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ ও মেরুকরণ হয়ে পড়েছে। জনগণের আস্থা নেই তাদের প্রতি। তারা পাকিস্তানকে এই সংকট থেকে টেনে তুলতে পারবে না।
বিতর্কিত সেনাবাহিনী
পাকিস্তানের এমন দশার জন্য সামরিক এবং গোয়েন্দা পরিষেবাগুলোকে প্রায়শই দায়ী করা হয়। শুরু থেকেই দেশটির সেনাবাহিনী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কখনও কখনও সামরিক অভ্যুত্থানে তারা ক্ষমতা দখল করেছে। অন্য সময়ে পর্দার আড়াল থেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে তারা।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইমরান খান ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় জয় পেয়েছিলেন। বিরোধীদলে থেকে সেই ইমরান এখন সেনাবাহিনীর সোচ্চার সমালোচক। বিশ্লেষকরা বলছেন, দিনে দিনে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা কমছে।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আমার মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর সিনিয়র নেতৃত্ব তাকে (ইমরান খান) রাজনীতিতে না দেখলে খুশিই হবে। আবার সেনাবাহিনীর নিম্ন ও মধ্যম পদের অনেকেই তার কট্টর সমর্থক। ইমরান খান রাজনীতির মেরুকরণ করেছেন। তিনি জনসাধারণ এবং সেনাবাহিনীকেও মেরুকরণ করেছেন। এটা বন্ধ করা কঠিন।
ইমরানকে গ্রেফতার করা হয়েছে দেশটির দুর্নীতি দমন সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো (এনএবি)-এর পরোয়ানার ভিত্তিতে। ১ মে সংস্থাটির চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) নাজির আহমেদ বাট এই পরোয়ানা জারি করেছেন। ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৯৯-এর ৯এ ধারায় ইমরানকে কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর এখনও অনেক ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে। অনেক সময় দেশটির বিচারব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর মিত্রদের কারণে এই প্রভাব আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে সংকটের সময় বিচার ব্যবস্থা সাধারণত সামরিক কর্মকর্তাদের পক্ষ নেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সাংবিধানিক ভূমিকার মধ্যে কাজ করতে হবে এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে।
দেশটির এক আইনজীবী ইমান মাজারি বলছেন, রাজনীতিকরা একসঙ্গে বসে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা না করলে আমরা অতীতের মতো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এবার মেরুকরণ চূড়ান্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। সামরিক-বিচারিক সংযোগের ফলে যে ভুলগুলো হয়েছে তার প্রতিকারের প্রয়োজন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজন। সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে যেতে না চাইলে নির্বাচন আয়োজনে বিলম্ব করা উচিত হবে না।
সূত্র: বিবিসি, ডয়চে ভেলে, ডন