
কেন চাঁদে ভারতীয় চন্দ্রযানের অবতরণ গুরুত্বপূর্ণ?
দীর্ঘ এক মাস নয় দিনের অভিযান শেষে ভারতের মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩ চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণ করেছে। এ সফলতায় ভারত শুধু যে বিশ্বের অভিজাত ‘মহাকাশ ক্লাবে’ জায়গা করে নিয়েছে তা নয়, দক্ষিণ মেরুতে প্রথমবার অবতরণ করে ইতিহাসও গড়েছে। বুধবার (২৩ আগস্ট) ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে চাঁদে অবতরণকারী হিসেবে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে দেশটি।
সম্প্রতি পানির অস্তিত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর সারা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ ও মনোযোগ এখন চন্দ্রপৃষ্ঠের ওই অঞ্চলটিতেই। এখানে পানি আছে বলে ধারণা করা হয়েছে। তাই গর্তগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা মহাকাশ বিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদে পাঠানো বেশিরভাগ মহাকাশযান নিরক্ষীয় অঞ্চলে। কিন্তু চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে গবেষণার জন্য অবতরণ করা প্রথম মহাকাশযান। এই হিসেবে চাঁদে ভারতীয় চন্দ্রযানের অবতরণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
চাঁদে পানি আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চন্দ্রযান-৩ এর লক্ষ্য। তাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে মনোযোগ দিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো।
দুই সপ্তাহে চন্দ্রযান-৩ পর্যায়ক্রমিকভাবে একটার পর একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। যার মধ্যে চন্দ্রপৃষ্ঠে কী কী ধরনের খনিজ পদার্থ আছে, তার একটি পর্যালোচনাও থাকবে।
চন্দ্রযান প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ইসরোর বিজ্ঞানী তুষারকান্তি দাস আনন্দবাজারে লেখা এক নিবন্ধে বলেছেন, এ এক দারুন অনুভূতি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পরিশ্রম, চিন্তা, চেষ্টা আর অনেক পরিকল্পনার পর আমাদের এই সাফল্য। আমরা এই আনন্দভরা সন্ধ্যার জন্যেই তো অপেক্ষা করে ছিলাম। চাঁদের বুকে দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক এমনই একটা ভোর। এখনও পর্যন্ত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৃথিবীর আর কোনও দেশ যেতে পারেনি। রাশিয়া কিছু দিন আগে চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। আমরাই প্রথম চাঁদের ‘কুমেরু’ জয় করলাম।
ভারতীয় চন্দ্রযান দিয়ে চাঁদের রহস্য উন্মোচন করবে। চাঁদের ভূতত্ত্ব, বায়ুমণ্ডল ও বাস্তুসংস্থান সম্পর্কে মহাকাশ গবেষকদের পথ সুগম করবে।
চন্দ্রযান-৩-এর সফল অবতরণ ভারতের ঐতিহাসিক অর্জনই না বরং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও অনুসন্ধানের নতুন পথ খুলে দেবে। যা মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এই কীর্তি চাঁদ সম্পর্কে সব আখ্যান ও গল্প বদলে দেবে। নতুন ইতিহাস লেখা হলো।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বার্তায় ভারতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটি মহাকাশ অনুসন্ধানে একটি বড় পদক্ষেপ এবং অবশ্যই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের চিত্তাকর্ষক অগ্রগতির প্রমাণ।
নাসার প্রশাসক বিল নেলসন সফল অবতরণের জন্য ইসরোকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, চাঁদে একটি মহাকাশযানকে সফলভাবে সফট-ল্যান্ড করার জন্য চতুর্থ দেশ হওয়ার জন্য ভারতকে অভিনন্দন। আমরা এই মিশনে আপনাদের অংশীদার হতে পেরে আনন্দিত।
স্পেসটেক-এর অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কার্লা ফিলোটিকো বলেছেন, দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের ফলে চাঁদে বরফ থাকলে তা অন্বেষণ করার সুযোগ পাবে ভারত। এটি চাঁদের ভূতত্ত্বের ক্রমবর্ধমান ডেটা এবং বিজ্ঞানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের বন্দর, নৌপরিবহন ও জলপথের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেন, চন্দ্রযান মিশনের অর্জনগুলো মানব জ্ঞান অন্বেষণের সীমানাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত উদাহরণ হয়ে থাকবে। চন্দ্রযান-৩ এর অবতরণ মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচন করবে। ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য মহাকাশ গষেণার পথ প্রশস্ত করবে।
এর আগে ২০১৯ সালে ভারতের চন্দ্রযান-২ মহাকাশযান চাঁদের বুকে সফট ল্যান্ডিংয়ের লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রায় চার বছর বাদে এসে চন্দ্রযান-৩ সেই লক্ষ্যে পুরোপুরি সফল হয়েছে।
ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের কাছাকাছি চলে এসছে। একটি সফল চন্দ্র অবতরণের জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে, চন্দ্রাভিযানের তাৎপর্য বুঝতে ও চন্দ্রযান-৩ মিশনের সমস্যা খুঁজে বের করা ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। যা মহাকাশ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, বিবিসি, রয়টার্স ও আনন্দবাজার