আন্তর্জাতিক

টাঙ্গাইল শাড়ি তুমি কার? বাংলাদেশ না পশ্চিমবঙ্গের? 

ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর কলকাতার ডিপারচার হলের এক প্রান্তে রয়েছে ‘বিশ্ব বাংলা’-র সুবিশাল বিপণি, যেখানে রাজ্যের শিল্পীদের হাতে তৈরি বিভিন্ন সম্ভার বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন শত শত দেশি-বিদেশি পর্যটক এখান থেকে সে সব কিনছেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের হাতে তৈরি এই ‘বিশ্ব বাংলা’ ব্র্যান্ডের দোকানে একটি বিশেষ ধরনের শাড়ির যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে–তা নিয়েই এখন শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। 

‘বিশ্ব বাংলা’-তে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে বিখ্যাত ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ও – কিন্তু তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে এই রকম: ‘টাঙ্গাইল শাড়ি যা হাতে বোনা হয় (পশ্চিমবঙ্গের) নদীয়া জেলার ফুলিয়াতে, এর বিশেষত্ব হলো তাঁত বা সিল্কের ওপর হাতে কাজ করা বুটি, ফ্লোরাল ডিজাইন, কনটেম্পোরারি মোটিভ ও টেক্সচার।’ 

এর সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ির আরও কী কী বৈশিষ্ট্য আছে, তা নিয়েও বেশ কয়েকটি বাক্য খরচ করা হয়েছে – কিন্তু এই শাড়ির উৎপত্তি যে বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে এবং সেই জায়গার নামেই এই শাড়ির নামকরণ, তা নিয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। ফলে একজন গড়পরতা বিদেশি পর্যটক এটা পড়ে বুঝতেই পারবেন না বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে এই শাড়ির আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে! তারা মনে করবেন এটা বোধহয় পুরোপুরি নদীয়া জেলার ফুলিয়ারই প্রোডাক্ট। 

সম্প্রতি কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াতের পথে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি পর্যটকের এই বিষয়টার প্রতি নজরও পড়েছে। কিন্তু তারা যখন বিশ্ব বাংলা বিপণির কর্মীদের এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন, তারা এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। 

এমনই একজন পর্যটক, চট্টগ্রামের জাহিদুল রাসেল এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আমার তো লেখাটা পড়েই খটকা লেগেছে। এয়ারপোর্টে বিশ্ব বাংলার স্টাফদের যখন জিজ্ঞেস করলাম টাঙ্গাইল শাড়ির বিবরণে টাঙ্গাইলের কোনও উল্লেখ নেই কেন, তারা বললেন তাদের সে সব কিছু জানা নেই – হেড অফিস থেকে যেরকম ছাপা হয়ে এসেছে তারা শুধু সেটাই টানিয়ে রেখেছেন!’       

বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার কলকাতার রাজারহাটে বিশ্ব বাংলা মার্কেটিং করপোরেশনের অফিসে যোগাযোগ করা হলেও এই প্রশ্নের কোনও জবাব মেলেনি। জনৈক কর্মকর্তা শুধু বলেছেন, তার বিষয়টি একেবারেই জানা নেই।  

বিশ্ব বাংলা বিপণিতে টাঙ্গাইল শাড়ির বর্ণনা

কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ি-কে কেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই বিপণিতে ফুলিয়া-র বলে দাবি করা হচ্ছে? 

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ছয় দশক। দেশভাগের পর ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে সেখানকার টাঙ্গাইল অঞ্চলের হিন্দু তাঁতিরা দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে চলে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ফুলিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলে। সেখানেই তারা শরণার্থী কলোনিতে নতুন করে জীবন শুরু করেন, সেই সঙ্গে রুটিরুজির জন্য আঁকড়ে ধরেন তাদের সাবেকি পেশা–টাঙ্গাইল শাড়ি বোনা।  

আজকের ফুলিয়ায় সবচেয়ে বিখ্যাত শাড়ির দোকানের কর্ণধার ও ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত শাড়ি-শিল্পী বীরেন কুমার বসাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘আমরা বসাকরা হলাম জাতে তাঁতি। আমাদের আদি নিবাস টাঙ্গাইলে, ছোটবেলা থেকে সেখানে বাজিতপুরের হাটে শাড়ির কেনাবেচা দেখে আসছি, যেখানে কলকাতা-বোম্বে-দিল্লি থেকেও মহাজন আর ব্যাপারিরা আসতেন। টাঙ্গাইলের শিবনাথ স্কুলে পড়তাম, যেখানে কাদের সিদ্দিকী ছিলেন আমার দু’বছরের সিনিয়র। সেই সব ছেড়েছুড়ে বাষট্টি সালে ফুলিয়াতে যখন চলে আসি, তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি।’  

বিশ্ব বাংলা বিপণিতে টাঙ্গাইল শাড়ির বর্ণনা

বীরেন কুমার বসাক মনে করেন, খোদ টাঙ্গাইলের চেয়েও এখন ফুলিয়াতেই অনেক বেশি ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ তৈরি হয় – সে কারণেই সম্ভবত এটাকে ফুলিয়ার প্রোডাক্ট হিসেবে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সেই সঙ্গেই বলছেন, ‘আসলে এটাকে এখন ফুলিয়ার শাড়ি নামেই পরিচিত করানোর সময় এসেছে – এটাকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলার কোনও অর্থই হয় না।’ 

তিনি আরও জানাচ্ছেন, ট্র্যাডিশনাল টাঙ্গাইল শাড়িতে বর্ডার থাকে, বডিটা প্লেইন হয় – আট, দশ বা পনেরো ইঞ্চি চওড়া আঁচলে নানা রকমের স্ট্রাইপ থাকে। কিন্তু এই ধরনের ‘খাঁটি’ টাঙ্গাইল শাড়ি আজকাল খুবই কম তৈরি হয়, ফুলিয়ার তাঁতিরাও নানারকম এক্সপেরিমেন্টের পথে হাঁটছেন এবং তাদের তৈরি শাড়িকে ‘ফুলিয়া শাড়ি’ বলাই ভালো। বস্তুত এই দাবি নিয়ে বীরেন কুমার বসাক খুব সম্প্রতি কলকাতায় জিআই (পেটেন্ট) অফিসে দেখাও করেছেন। 

ওদিকে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে শাড়ি ব্যবসায়ীরা বিশ্ব বাংলার এই বর্ণনা নিয়ে কী বলছেন? 

টাঙ্গাইল শহরের আদালতপাড়ায় খুব পুরনো দোকান ‘টাঙ্গাইল শাড়ি হাউজ’। সেই দোকানের মালিক রফিউল আলম সব শুনেটুনে বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না কেন টাঙ্গাইল শাড়িকে ওরা ফুলিয়ার বলে দাবি করছেন, তবে এটা ঘটনা যে আমাদের টাঙ্গাইল অঞ্চলের বেশিরভাগ তাঁতি ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর-ফুলিয়া সাইডে চলে গেছেন। এখন আমরা এখানে যে সব শাড়ি বিক্রি করি তার বেশির ভাগই পাবনার তাঁত, অরিজিনাল টাঙ্গাইল শাড়ি হাতেগোনা দোকানেই পাওয়া যায় – আর সংখ্যাতেও খুব কম।’ 

কিন্তু যেখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ির পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে যে টাঙ্গাইলের কথাই উল্লেখ করা দরকার, তা বলতে প্রবীণ রফিউল আলমের কোনও দ্বিধা নেই। 

‘শাড়িটার নাম যে জায়গাটার নামে, সেটা তো অবশ্যই বলা দরকার। এটুকু ঋণ স্বীকার করতে কীসের অসুবিধা, তা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না’, বলছিলেন তিনি। 

টাঙ্গাইল শাড়ির নামে এখনও কোনও জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস) পেটেন্ট আন্তর্জাতিক স্তরে নথিভুক্ত হয়নি – কলকাতার বিশ্ব বাংলা বিপণি সেটারই সুযোগ নিয়ে একে ফুলিয়ার পণ্য বলে চালিয়ে দিচ্ছে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।  

Source link

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Stream TV Pro News - Stream TV Pro World - Stream TV Pro Sports - Stream TV Pro Entertainment - Stream TV Pro Games - Stream TV Pro Real Free Instagram Followers PayPal Gift Card Generator Free Paypal Gift Cards Generator Free Discord Nitro Codes Free Fire Diamond Free Fire Diamonds Generator Clash of Clans Generator Roblox free Robux Free Robux PUBG Mobile Generator Free Robux 8 Ball Pool Brawl Stars Generator Apple Gift Card Best Android Apps, Games, Accessories, and Tips Free V Bucks Generator 2022