আন্তর্জাতিক

দ্বিতীয় বছরে যুদ্ধ: পাল্টাতে পারে বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র

যুদ্ধ বিশ্বকে বদলে দেয়। তাৎক্ষণিক মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র, গোষ্ঠী, সংস্কৃতি ও নেতাদের ভাগ্য বদলে দেয়। সম্পদ ও প্রভাবের ব্যবহারের সুযোগের নতুন ধারা তৈরি হয়, নির্ধারণ করে দেয় কার কী আছে – কার কী নেই। এতে এমন রীতি প্রতিষ্ঠিত হয় যার আলোকে ভবিষ্যতের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। আর দখল অভিযানের ক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে দিতে পারে।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি উসকানি ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের এক বছর পূর্তিতে দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ এসব বিপদের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

ইউক্রেন নিজের টিকে থাকার জন্য চলমান সংঘাতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর ইউক্রেন দখলে ব্যর্থ হলেও তা ধ্বংস করতে পারলেই রাশিয়া সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। লড়াই বন্ধের কোনও ইঙ্গিত দেখাচ্ছে না উভয়পক্ষ।

নির্মম বাস্তবতা হলো রাশিয়া বা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পুরোপুরি বিপর্যয় ছাড়া যুদ্ধ ২০২৩ সালজুড়ে চলতে পারে- এবং হয়ত এই বছরেও যুদ্ধের অবসান হবে না। 

২০২৩ সাল গুরুত্বপূর্ণ

কিন্তু ইউক্রেনে ২০২৩ সালে যা ঘটবে তা হবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই বছরেই প্রকাশ পেয়ে যাবে কোনও পক্ষ জয়ী হতে পারবে কিনা অথবা সংঘাতে অচলাবস্থা আসবে কিনা।

চলতি বছরে যুদ্ধের অগ্রগতি কেমন হয় তা তুলে ধরবে নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পশ্চিমাদের মানসিক দৃঢ়তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। কিয়েভের প্রতি এই সহযোগিতা কি প্রয়োজন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, ধীর গতির সহযোগিতায় তীব্রতা আসবে, নাকি উদাসীনতা ও যুদ্ধের অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

এই মুহূর্তে ইউক্রেন ভালো অবস্থানে রয়েছে। যদিও রুশ সেনারা কিছু দিন ধরে মোমেন্টাম ফিরে পাচ্ছে। কিন্তু আগামী মাসগুলোতে কিয়েভকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

প্রথমত, ইউক্রেনকে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকিয়ে নিজের পাল্টা হামলা চালাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে পশ্চিমা ভারী অস্ত্র, দূরপাল্লার হামলা চালানোর মতো ক্ষেপণাস্ত্র এবং সম্ভবত যুদ্ধবিমান।

দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও সহযোগিতা। যাতে করে অর্থনৈতিক ধসের কারণে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে না পড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।

স্পটলাইটে পুতিনের বাহিনী ও তার কর্তৃত্ব

আলোচনার খাতিরে, যুদ্ধের গতি পাল্টে দিতে হলে রাশিয়াকে নিজের সশস্ত্রবাহিনীর দক্ষতা নাটকীয় মাত্রায় বাড়াতে  হবে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বে ভুহলেদারে রাশিয়ার ব্যর্থতা তাদের জন্য খুব আশাব্যঞ্জক না। বসন্তের আক্রমণের আগে এই আক্রমণকে অনেকেই মহড়া হিসেবে বিবেচনা করছেন।

ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ার পদাতিক বাহিনীর প্রায় ৮০ শতাংশ ইউক্রেন সংঘাতে মোতায়েন রয়েছে। এদের সঙ্গে রয়েছে কয়েক লাখ নতুন নিয়োগ দেওয়া সেনা। যারা রণক্ষেত্রে পৌঁছাতে শুরু করেছে। দ্রুত সাফল্য অর্জনের চাপ বাড়ছে রাশিয়া শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর।

এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে তার দায় পড়বে পুতিনের ঘাড়ে। সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তাকে ক্রমাগত নিপীড়ক হতে হচ্ছে, নিষিদ্ধ করতে হচ্ছে বই, নতুন সেনা নিয়োগের পথে যেতে হচ্ছে এবং যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের কারাগারে পাঠাতে হচ্ছে।

আর সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে আন্তঃকোন্দল প্রমাণ দিচ্ছে রুশ প্রশাসনে পুতিনের কর্তৃত্ব আগের মতো অটুট না।

অবশ্য, আরেকটি রুশ বিপ্লব (ওপর বা নিচ থেকে) এখনও অনেক দূরবর্তী বিষয়। রাশিয়া রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে পুতিনকে সরিয়ে বিকল্প বসানোর মতো কেউ নেই। এমন চেষ্টার ব্যক্তিগত ঝুঁকিও মারাত্মক। বাস্তবতা হলো যুদ্ধ নিয়ে রুশ সমাজ খুব উৎসাহী না থাকলেও কার্যত উদাসীন থাকবে।

এমন পরিস্থিতি বদলাতেও পারে। পুতিন আজীবন পশ্চিমাদের দায়ী করে যেতে পারবেন না, অথবা নিজের ভুলের কারণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে শুদ্ধি অভিযান চালাতে পারবেন না। তার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে যে যুক্তি তিনি রুশদের কাছে তুলে ধরেছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, তাদের সুরক্ষা দেওয়া, জীবনমানের উন্নতিসহ স্থিতিশীল জীবন নিশ্চিত করা। গত ১২ মাসে তিনি উভয় প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছেন। ইউক্রেনে লড়াইয়ের জন্য কয়েক লাখ নতুন সেনা নিয়োগ দিয়েছেন, তার পদক্ষেপের কারণে কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে।

নতুন নিয়োগকৃত সেনাদের ইউক্রেনে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করে, ২০২২ সালে নিজেদের সার্বভৌম সম্পদ শূন্য করা থেকে শুরু অর্থনীতির ক্ষতি ডেকে আনা, রুশ সমাজে দ্বিগুণ চাপ সৃষ্টি করেছেন পুতিন।

অঘোষিত কিয়েভ সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: এপি

যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে চলতি বছরেই বাড়বে

পুতিনের জন্য দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক বেশি কঠিন হলে তিনি সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধির ঝুঁকি নিতে পারেন।

ইতোমধ্যে গত ১২ মাসে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বিশ্বের খাদ্যের ঘাটতি নিয়ে ক্রেমলিন কর্মকর্তাদের তোষামোদি, পারমাণবিক ধ্বংসের হুমকি, ডার্টি বোমা ব্যবহারের আশঙ্কা এবং মস্কোর বিরোধিতাকারীদের নাৎসী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত পশ্চিমারা কৌশলে এবং ক্রেমলিনের হুমকির সমানুপাতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। গত বছরে পশ্চিমাদের রুশ জ্বালানি নির্ভরতা কমে গেছে অনেকটাই। এতে কৌশলে সুবিধা আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হারিয়েছে মস্কো। কিন্তু ২০২৩ সালে পশ্চিমাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে মস্কো নিজের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে পারে।

ইতোমধ্যে মলদোভার সরকার উৎখাতে রুশ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এসেছে। সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদীদের সহযোগিতা দেওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এতে ব্ল্যাকমেইল, সাইবার হামলা, নাশকতা এবং এমনকি ন্যাটো ভূখণ্ডে হত্যাকাণ্ডও থাকতে পারে।

পূর্ব দিকে বাড়বে ন্যাটোর মনোযোগ

ন্যাটোর মনোযোগের কেন্দ্র আরও পূর্ব দিকে বাড়তে পারে। পোল্যান্ড ও এস্তোনিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে সামনে এসেছে। জার্মানি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর ইউক্রেনে সহযোগিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তাদের চাপ ছিল। ন্যাটোর সদস্য প্রত্যাশী ফিনল্যান্ড ও সুইডেনও ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। উভয় দেশ ২০২২ সালে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

হাঙ্গেরি বাদে ২০১৫ সালে ক্রিমিয়াতে রুশ আক্রমণের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ‘বুখারেস্ট নাইন’ গ্রুপ ন্যাটোর মধ্যে শক্তিশালী কণ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউক্রেনে আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থা পাঠানোর পক্ষে ওকালতি করছে তারা।

জানুয়ারিতে পোল্যান্ড সামরিক ব্যয় জিডিপির ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিনতে যাচ্ছে। পোল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ও বেড়েছে। বিশেষ করে ন্যাটো ব্যবস্থা, সেনা এবং ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে।

ন্যাটোর জন্য চ্যালেঞ্জ হলো ইউক্রেন নিয়ে ন্যাটো মিত্রদের সম্ভাব্য ভিন্নতা ও ফাটল।

শেষ পর্যন্ত যারা ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের একটি মসৃণ অবসান প্রত্যাশা করছেন তারা ২০২৩ সালে হতাশ হতে পারেন। যেমন হতাশ তারা ১২ মাস আগে হয়েছেন। গত বছর বিশ্বকে অনেক কিছু শিখিয়েছে: কীভাবে দুর্বলরা শক্তিশালীদের প্রতিরোধ করতে পারে; যেকোনও মূল্যে শান্তি চাওয়ার বিপদ কেমন হতে পারে; স্বৈরাচারীদেরর আভিজাত্যের প্রলোভন দিয়ে কিনতে পারার ভ্রম।

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা শিখিয়েছে তা সম্ভবত যুদ্ধ নিয়ে আমাদের মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এখন, ইউরোপে যে যুদ্ধকে অনেকেই অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন সেই যুদ্ধের এক বছরের শিক্ষা হতে পারে প্রকৃত অর্থে বিশ্বকে কতটা বদলে দেয় যুদ্ধ, তা পুনরায় জানতে পারা।

দ্য কনভারসেশন অবলম্বনে।

 

Source link

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Stream TV Pro News - Stream TV Pro World - Stream TV Pro Sports - Stream TV Pro Entertainment - Stream TV Pro Games - Stream TV Pro Real Free Instagram Followers PayPal Gift Card Generator Free Paypal Gift Cards Generator Free Discord Nitro Codes Free Fire Diamond Free Fire Diamonds Generator Clash of Clans Generator Roblox free Robux Free Robux PUBG Mobile Generator Free Robux 8 Ball Pool Brawl Stars Generator Apple Gift Card Best Android Apps, Games, Accessories, and Tips Free V Bucks Generator 2022