
ব্রিকস কি পারবে মার্কিন ডলারের বিকল্প মুদ্রা আনতে?
৮০ বছর ধরে মার্কিন ডলার অন্যান্য সব মুদ্রার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। কিন্তু বৈশ্বিক শাসন ও অর্থব্যবস্থায় পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিতে ক্লান্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি গোষ্ঠী এটির আধিপত্য কমাতে বদ্ধপরিকর।
মঙ্গলবার ব্রিকস সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর (ডি-ডলারাইজেশন) প্রক্রিয়াটি ‘অনিবার্য’ এবং ‘গতি অর্জন করছে’। এই সম্মেলনে ব্রাজিল, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা তিনদিনের সম্মেলনে একত্রিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডলার হলো বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের বেশিতে এই মুদ্রা ব্যবহৃত হয় বলে অনুমান করা হয়।
এ বছরের শুরুর দিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন সব দেশকে তাদের বাণিজ্য ডলারের ওপর ভিত্তি করে করতে হবে। এর আগে, রাশিয়ার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ব্রিকস গ্রুপ নিজস্ব মুদ্রা তৈরিতে কাজ করছে।
ডলারের আধিপত্য থেকে দূরে সরতে বৈশ্বিক পরিবর্তনের আহ্বান নতুন নয়, বা ব্রিকসের ক্ষেত্রেও অনন্য নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং পশ্চিমা ও রাশিয়া-চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বিষয়টিকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক জব্দ এবং আন্তর্জাতিক অর্থ বিনিময়ের মেসেজিং নেটওয়ার্ক সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র চীনে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি রফতনির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের একজন সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো শার্লি জে ইউ বলেছেন, ইরান ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং রিজার্ভের জন্য বিকল্প মুদ্রা খোঁজা ও সুইফটের বিকল্প বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুদের হার বাড়িয়েছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের ডলার ঋণের ওপর উচ্চহারে সুদ প্রদান এবং একটি শক্তিশালী ডলারের বিনিময় হারের প্রভাবের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রা বা অন্যান্য মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার আগ্রহ অর্থনৈতিক বিবেচনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
রাশিয়া-আফ্রিকা সম্পর্কের নীতি বিশ্লেষক গুস্তাভো ডি কারভালহো বলেছেন, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর বিকল্প খোঁজার চেষ্টা বাস্তবভিত্তিক বিবেচনা, নৈতিক নয়। তারা সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন তুলছে, বিশ্বব্যাপী একটি মুদ্রার সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে আমরা যে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছি তা হয়ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গত সপ্তাহে জোহানেসবার্গে ব্রিকস এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থার ওপর একটি কর্মশালায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ডি কারভালহো কিছু বিকল্প তুলে ধরেছেন তিনি মনে করেন, ব্রিকস দেশগুলো এগুলো বিবেচনা করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, ব্রিকস দেশগুলোর মুদ্রার মধ্যে থেকে কয়েকটি বেছে নেওয়া, একটি নতুন সম্ভাব্য মুদ্রার ভিত্তি হিসেবে স্বর্ণ বা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের কথা বিবেচনা করতে পারে।
তিনি বলেছিলেন, বিকল্পগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে এবং সম্ভবত স্বল্প মেয়াদের তুলনায় অনেক বেশি মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদী।
ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা?
সম্ভাব্য মুদ্রার বিকল্পগুলো বিবেচনা করে প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব স্কলারশিপের অধ্যাপক ড্যানি ব্র্যাডলো বলছেন, আবার স্বর্ণকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহারে অনেকে ফিরে যেতে চাইবে না। ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, আপনি কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করবেন, কোন স্থিতিশীল মুদ্রা এবং তাদের কোনোটিই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশেষভাবে কার্যকর বলে দেখা যায়নি।
একটি পৃথক ব্রিকস মুদ্রা তৈরির বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের একজন সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো শার্লি জে ইউ বলেছেন, ব্রিকস মুদ্রা তৈরির জন্য একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে। প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য একটি সাধারণ মান এবং ভিত্তিমূল্য প্রয়োজন। এগুলো অর্জন করা খুবই কঠিন, যদিও অসম্ভব নয়।
ম্যাক্রো-অ্যাডভাইজরির একজন বিনিয়োগ বিশ্লেষক ক্রিস ওয়েফার রাশিয়া ও ইউরেশিয়াকে কেন্দ্র করে একটি ব্রিকস মুদ্রার ধারণাটিকে উপযুক্ত হিসেবে মনে করেন না। তিনি বলেন, এমনকি বিভিন্ন সরকারের লোকেরাও জানে এটি ঘটবে না বা দীর্ঘ সময় নিয়েও হবে না।
ওয়েফারের মন্তব্যের সঙ্গে একমত অধ্যাপক ব্র্যাডলো। ব্রিকসের পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে প্রধান পার্থক্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রুপটির ডলারের বিকল্প তৈরি করার ধারণাটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যদি তাদের একটি একক মুদ্রা যদি হয়ও তাতে গ্রুপটির বৃহত্তম ও শক্তিশালী অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত হবে। আর এই অর্থনীতির দেশ হলো চীন। কেন ছোট দেশগুলো তাদের আর্থিক নীতি ও তাদের আর্থিক নীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে চীনা অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করতে চাইবে? এতে সব ধরণের ঝুঁকির ক্ষেত্র খুলে যাবে এবং তাদের কর্মের স্বাধীনতাকে এমনভাবে সীমাবদ্ধ করবে যা তাদের সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য হবে।
ডলার প্রতিস্থাপনের বিকল্পগুলো নিয়ে আলোচনায় যখন একটি সম্ভাব্য মুদ্রার ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছেতখন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলল বলেছেন, ডলার প্রতিস্থাপনের চেয়ে বড় লক্ষ্য হলো বিশ্বকে আরও বিকল্প দেওয়া। ব্রিকস পশ্চিমা বিরোধী নয়। আমরা প্রতিযোগিতায় নেই। আমরাও ডলারের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমরা বিশ্বব্যাপী আর্থিক মিথস্ক্রিয়ায় ডলারের ক্রমাগত আধিপত্যের বিরুদ্ধে।
ওয়েফার বলেছেন, ব্রিকস যে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে চায় সেগুলোর কথা বাদ দিলেও গ্রুপটি যদি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া হিসেবে আবির্ভূত হয় তাহলে এর বিকাশের সুযোগ খুব বেশি থাকবে না।
তিনি বলেন, আমি মনে করি না কেউ এটি চায়।
স্থানীয় মুদ্রা
ওয়েফার বলছেন, ডলারের বিকল্প খোঁজার ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রার বৃহত্তর ব্যবহারে ব্রিকস জোর দিতে পারে। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে জানি রাশিয়া ও চীনের মধ্যে ৮০ শতাংশ বাণিজ্য হয় রাশিয়ার রুবল বা চীনা ইউয়ানে। রাশিয়া ভারতের সঙ্গেও রুপিতে লেনদেন করছে। সুতরাং একটি নতুন মুদ্রার কথা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা বা রাশিয়ার মুদ্রার স্থায়ী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
এমনকি মূল ব্রিকস গ্রুপের বাইরেও অন্যান্য দেশ স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ভারত গত মাসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে তারা ডলারের পরিবর্তে রুপিতে বাণিজ্য পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক ব্যবহার রূপান্তরযোগ্যতাকে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়। ওয়েফার বলেছেন, যেসব দেশের মধ্যে বেশি লেনদেন হয় তাদের একে অপরের মুদ্রা রিজার্ভ রাখতে হবে। সেগুলোকে নিজ দেশের মুদ্রায় রূপান্তরে সক্ষম হতে হবে।
ভারতে এটা কঠিন। কারণ দেশটিতে পুঁজি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিনা অনুমতিতে দেশের বাইরে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। একবার রুপি ভারতের বাইরে চলে গেলে, এটিকে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করার আগে ডলারের মতো মুদ্রায় রূপান্তার করতে হবে।
ওয়েফার বলেছেন, ফলে অনেক ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। ভারতকে মূলধন নিয়ন্ত্রণ বাদ দিতে হবে এবং প্রায় সুইফটের মতো বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তারপরে প্রতিটি দেশকে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য অংশীদারের মুদ্রা বেশি রিজার্ভ করতে হবে। এই পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে এবং দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ব্র্যাডলো বলেছেন, ব্রিকস দেশগুলোর স্থানীয় মুদ্রার বেশি রিজার্ভ থাকা একটি ‘খুব প্রশ্নবিদ্ধ’ কৌশল কারণ একটি রিজার্ভ মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় স্থিতিশীল এবং দ্রুত স্থানান্তর করার সুযোগ থাকতে হয়। ডলার একমাত্র মুদ্রা যা এই মুহূর্তে এমন সব সুবিধা দিচ্ছে।
ব্র্যাডলো আরও বরেছেন, একটি দেশ কার সঙ্গে বাণিজ্য করছে সেই প্রশ্নটিও নির্ধারণ করবে এটি কোন মুদ্রা গ্রহণে ইচ্ছুক।
উদাহরণ হিসেবে, চীনের সঙ্গে প্রচুর বাণিজ্য করা দক্ষিণ আফ্রিকা ইউয়ানের রিজার্ভ রাখতে আগ্রহী হতে পারে, কিন্তু পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্যে থাকা অপর অংশীদারদের ব্রাজিলের রেইস বা রাশিয়ার রুবলের চেয়ে ডলারের প্রয়োজন হবে বেশি।
রাজা থাকবে ডলার
দক্ষিণ আফ্রিকার সুকলল এবং অন্যান্য ব্রিকস নেতাদের কাছে ডলারের বিকল্পের যুক্তি সাধারণভাবে শাসন কাঠামো পরিবর্তনের মতোই। সুকলল বলেছেন, আমরা একটি বহুমুখী সমাজে, একটি বহুমুখী বিশ্বে বাস করতে চাই। ৭০, ৮০ ও ৯০ এর দশকে যেসব দেশ বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তারা এখন বাণিজ্যে প্রাধান্য পায় না। সেই যুগ শেষ। আমরা পছন্দের বহুমুখীতা, একটি বহুমুখী আর্থিক বিশ্ব দেখতে চাই। আমরা পছন্দের মুদ্রা হিসেবে এক বা দুটি মুদ্রার সঙ্গে যুক্ত হতে চাই না।
সুকলল প্যান-আফ্রিকান পরিশোধ এবং বন্দোবস্ত ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এটি একটি আন্তঃদেশীয় অবকাঠামো যা সমগ্র মহাদেশজুড়ে সরাসরি আর্থিক লেনদেনের সুবিধার্থে তৈরি হয়েছে। তিনি এই মডেল অনুসরণ করার বিষয়টি বিবেচনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, শুধু সুইফট ব্যবস্থা ব্যবহার বাদ দিয়ে এটি ব্যবহার করলে বছরে ৫০০ কোটি ডলার লেনদেন ফি সাশ্রয় হবে।
তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতেও ডলার রাজা থাকবে।
ওয়েফারের মতে, এর আধিপত্যকে সত্যিই চ্যালেঞ্জ করে এমন কিছু থেকে আমরা এখনও ‘কয়েক দশক’ দূরে। ব্রিকস একটি সাধারণ মুদ্রা তৈরি করলেও এটি শেষ পর্যন্ত ইউরোর মতোই কাজ করতে পারে, যা ডলারের আধিপত্যকে গুরুতরভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি।
ওয়েফার বলেন, তেল ও অন্যান্য পণ্যের জন্য ‘রেফারেন্স মূল্য হলো ডলারের মূল্য’। বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশগুলো এখনও তারা কী কিনবে এবং বিক্রি করবে সেটির মূল্য নির্ধারণ করতে গ্রিনব্যাক ব্যবহার করবে।
আল জাজিরা অবলম্বনে।